ঢাকা ০৮:২২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমাদের এই দেশে শীতের অতিথি পাখিদের আতিথিয়তা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৮:৫৪:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭
  • ৫৬১ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঋতুচক্রের এ দেশে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে শীত। আমাদের আতেথিয়তার মাস। নদী-নালা আর খাল-বিল নিয়ে আমাদের দেশ। এ দেশ প্রকৃতির লীলাভূমি। আর প্রাকৃতিক এ লীলাভূমির সৌন্দর্য ও রূপলাবণ্য দেখে মানুষ ও প্রাণী সবাই মুগ্ধ। মুগ্ধতার মধুর টানে ছুটে আসে অতিথি পাখি।

প্রতি বছর সহস্রাধিক অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এ দেশ। সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দলবেঁধে আসে এসব পাখি। মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত এরা কলকাকলিতে আমাদের প্রকৃতিকে ভরিয়ে তোলে। এরপর শুরু হয় নিজ দেশে ফিরে চলা। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিসেম্বর-জানুয়ারি এ দু’ মাসে সবচেয়ে বেশি পাখি এদেশে আসে। সময়টাতেই ডানা মেলে ভেসে আসে উত্তরের অতিথি শীতের পাখিরা। প্রতি বছরই ওরা আসে। ঝাঁকে ঝাঁকে। নানা রং আর আকৃতির সেসব পাখির কূজনে মুখরিত হয় নদীপাড়, বিল-ঝিল, বন-বাদাড় সব। বাংলাদেশেল বেশ কিছু জায়গায় আনা গোনা দেখা যায তাদের।

এরমেধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মিরপুর চিড়িয়াখানা, মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের পাশের লেক, ঢাকার পিলখানা, বালুচরা, মহেশখালী দ্বীপ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, পঞ্চগড়ের ভিতরগড়, চরভাটা, শিবালয়, হালহাওর, হাকালুকি হাওর,  কুয়াকাটা, ঘাটিভাঙ্গা, কলাদিয়া, চরণদ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ, চর ওসমান, শাহীবানীচর, সন্দ্বীপ, চরমনতাজ, নেত্রকোনার কলমকান্দার হাওর, কিশোরগঞ্জ হাওর, সুনামগঞ্জ, হাওর হাতিয়া দ্বীপ, চরপিয়া, ডালচর যামিরচর, মৌলবীবাজার, টাঙ্গুয়ার হাওর, চরকুকড়িমুকড়ি, গলাচিপা, খেপুপাড়া, জোনাকচর,  বুড়ীগঙ্গা নদী,হোয়াইকিয়ং, শাহপুরীর দ্বীপ, মনপুরা, সোনারচর, চরনিজাম,  চরমানিক, চরদিয়াল, আগুনমুখা প্রভৃতি।

প্রতি শীতের বছর শীতের শুরুতে বাংলাদেশের এসব এলাকার জলাশয়গুলো ছেয়ে যায় যাযাবর পাখির ঢলে। নিজ আবাস ত্যাগকারী এসব পাখির আবাস সাইবেরিয়াসহ হিমালয়ের বনাঞ্চলে এদের বাস। প্রাণী বিজ্ঞানীদের কথায়, বাংলাদেশের পাখি দুই শ্রেণির। আবাসিক আর অনাবাসিক। অতিথি পাখিরা অনাবাসিক শ্রেণির। শীতের মৌসুমে আসা অতিথি পাখিদের মধ্যে রয়েছে বক, শামুককনা, চখাচখিম সারস, কাইমা,শ্রাইক, গাঙ বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, কবুতর, বনহুর, হরিয়াল, নারুন্দি, জলপিপি, রাজসরালি, লালবুবা, পানকৌড়ি, মানিকজোড় সহ নাম না জানা কতো কি পাখি। প্রতিবছর বাংলাদেশে ১৪-১৫ প্রজাতির হাঁস এসে থাকে।

অতিথিদের আগমনের সাথে সাথে শিকারির রক্তে জাগে খুনের নাচন। অতিথি পাখির জন্যে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২টি অভয়ারণ্য থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অভয়ারণ্য বলতে যা বুঝায় তা আজও পরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠেনি। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের ২৬ ধারা মতে পাখি শিকার ও হত্যা দন্ডনীয় অপরাধ। শীতের শুরুতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় অতিথি পাখি হত্যা, জাল ব্যবহার ও শিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু আইনগত কার্যকারিতা দেখায়। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই এ তৎপরতায় ভাটা পড়ে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থা জাতীয় সংসদের সামনেও দিনের বেলা অতিথি পাখি অবাধে বিক্রি হতে দেখা যায়।কতৃপক্ষের নাকের ডগায় অতিথিদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়।

এখানে একটি ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়া দরকার যে, পাখি শিকারের অস্ত্র হিসেবে প্রধানত এয়ারগান ব্যবহার করা হয়। কার্যকারিতার দিক থেকে পাখি মারা ছাড়া আর কোনো কাজে এয়ারগানের ব্যবহার নেই। এয়ারগান কেন আর লাইসেন্স করার উদ্দেশ্য একটাই পাখি শিকার। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা এসব যে জানেন না, তা নয়। ভালোই জানেন তারা। কিন্তু সব জেনেও কেন এয়ারগান ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা করা হচ্ছে না? তা আমার বুঝে আসে না! পত্র-পত্রিকায় এর ছবিও ছাপা হয়। কিন্তু এতেও কতৃপক্ষের টনক নড়ে না। বার বার একই ছবির পুনরাবৃত্তি ঘটে।

পাখি শিকার মানেই নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা আর নৃশংসতা। আমাদের অতিথীদের মাংস দিয়েই আমরা শীতকে উদযাপন করি। যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জারও বটে।

সারা পৃথিবীতেই এইসব পরিব্রাজক পাখিরা শিকারিদের কবলে পরে। তাদের রক্ষার বিষয়ে সচেতনতার জন্য ২০০৬ থেকে মে মাসের ১০ ও ১১ তারিখকে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও প্রাণি রক্ষা সম্পর্কিত সংগঠন গুলো এ দিবসটি গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকে। তবে সামাজিক সচেতনতা কতটুকু বৃদ্ধি করতে পেরেছে তা আমাদের কর্মকান্ড দেখলেই বুঝা যায়। যখন আমরা অতিথি হত্যা করে তাদের মাংস খেয়েই  আমাদের আতিথিয়তা পালন করে থাকি।

যে পাখি নিসর্গকে এত সুন্দর করে, চোখকে এত প্রশান্তি দেয়, সৌন্দর্য চেতনাকে এত আলোড়িত করে, নিরীহ সে পাখির প্রাণ নেওয়াতে কী এত সুখ মানুষের?

লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

আমাদের এই দেশে শীতের অতিথি পাখিদের আতিথিয়তা

আপডেট টাইম : ০৮:৫৪:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঋতুচক্রের এ দেশে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে শীত। আমাদের আতেথিয়তার মাস। নদী-নালা আর খাল-বিল নিয়ে আমাদের দেশ। এ দেশ প্রকৃতির লীলাভূমি। আর প্রাকৃতিক এ লীলাভূমির সৌন্দর্য ও রূপলাবণ্য দেখে মানুষ ও প্রাণী সবাই মুগ্ধ। মুগ্ধতার মধুর টানে ছুটে আসে অতিথি পাখি।

প্রতি বছর সহস্রাধিক অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এ দেশ। সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দলবেঁধে আসে এসব পাখি। মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত এরা কলকাকলিতে আমাদের প্রকৃতিকে ভরিয়ে তোলে। এরপর শুরু হয় নিজ দেশে ফিরে চলা। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিসেম্বর-জানুয়ারি এ দু’ মাসে সবচেয়ে বেশি পাখি এদেশে আসে। সময়টাতেই ডানা মেলে ভেসে আসে উত্তরের অতিথি শীতের পাখিরা। প্রতি বছরই ওরা আসে। ঝাঁকে ঝাঁকে। নানা রং আর আকৃতির সেসব পাখির কূজনে মুখরিত হয় নদীপাড়, বিল-ঝিল, বন-বাদাড় সব। বাংলাদেশেল বেশ কিছু জায়গায় আনা গোনা দেখা যায তাদের।

এরমেধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মিরপুর চিড়িয়াখানা, মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের পাশের লেক, ঢাকার পিলখানা, বালুচরা, মহেশখালী দ্বীপ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, পঞ্চগড়ের ভিতরগড়, চরভাটা, শিবালয়, হালহাওর, হাকালুকি হাওর,  কুয়াকাটা, ঘাটিভাঙ্গা, কলাদিয়া, চরণদ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ, চর ওসমান, শাহীবানীচর, সন্দ্বীপ, চরমনতাজ, নেত্রকোনার কলমকান্দার হাওর, কিশোরগঞ্জ হাওর, সুনামগঞ্জ, হাওর হাতিয়া দ্বীপ, চরপিয়া, ডালচর যামিরচর, মৌলবীবাজার, টাঙ্গুয়ার হাওর, চরকুকড়িমুকড়ি, গলাচিপা, খেপুপাড়া, জোনাকচর,  বুড়ীগঙ্গা নদী,হোয়াইকিয়ং, শাহপুরীর দ্বীপ, মনপুরা, সোনারচর, চরনিজাম,  চরমানিক, চরদিয়াল, আগুনমুখা প্রভৃতি।

প্রতি শীতের বছর শীতের শুরুতে বাংলাদেশের এসব এলাকার জলাশয়গুলো ছেয়ে যায় যাযাবর পাখির ঢলে। নিজ আবাস ত্যাগকারী এসব পাখির আবাস সাইবেরিয়াসহ হিমালয়ের বনাঞ্চলে এদের বাস। প্রাণী বিজ্ঞানীদের কথায়, বাংলাদেশের পাখি দুই শ্রেণির। আবাসিক আর অনাবাসিক। অতিথি পাখিরা অনাবাসিক শ্রেণির। শীতের মৌসুমে আসা অতিথি পাখিদের মধ্যে রয়েছে বক, শামুককনা, চখাচখিম সারস, কাইমা,শ্রাইক, গাঙ বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, কবুতর, বনহুর, হরিয়াল, নারুন্দি, জলপিপি, রাজসরালি, লালবুবা, পানকৌড়ি, মানিকজোড় সহ নাম না জানা কতো কি পাখি। প্রতিবছর বাংলাদেশে ১৪-১৫ প্রজাতির হাঁস এসে থাকে।

অতিথিদের আগমনের সাথে সাথে শিকারির রক্তে জাগে খুনের নাচন। অতিথি পাখির জন্যে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২টি অভয়ারণ্য থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অভয়ারণ্য বলতে যা বুঝায় তা আজও পরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠেনি। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের ২৬ ধারা মতে পাখি শিকার ও হত্যা দন্ডনীয় অপরাধ। শীতের শুরুতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় অতিথি পাখি হত্যা, জাল ব্যবহার ও শিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু আইনগত কার্যকারিতা দেখায়। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই এ তৎপরতায় ভাটা পড়ে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থা জাতীয় সংসদের সামনেও দিনের বেলা অতিথি পাখি অবাধে বিক্রি হতে দেখা যায়।কতৃপক্ষের নাকের ডগায় অতিথিদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়।

এখানে একটি ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়া দরকার যে, পাখি শিকারের অস্ত্র হিসেবে প্রধানত এয়ারগান ব্যবহার করা হয়। কার্যকারিতার দিক থেকে পাখি মারা ছাড়া আর কোনো কাজে এয়ারগানের ব্যবহার নেই। এয়ারগান কেন আর লাইসেন্স করার উদ্দেশ্য একটাই পাখি শিকার। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা এসব যে জানেন না, তা নয়। ভালোই জানেন তারা। কিন্তু সব জেনেও কেন এয়ারগান ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা করা হচ্ছে না? তা আমার বুঝে আসে না! পত্র-পত্রিকায় এর ছবিও ছাপা হয়। কিন্তু এতেও কতৃপক্ষের টনক নড়ে না। বার বার একই ছবির পুনরাবৃত্তি ঘটে।

পাখি শিকার মানেই নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা আর নৃশংসতা। আমাদের অতিথীদের মাংস দিয়েই আমরা শীতকে উদযাপন করি। যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জারও বটে।

সারা পৃথিবীতেই এইসব পরিব্রাজক পাখিরা শিকারিদের কবলে পরে। তাদের রক্ষার বিষয়ে সচেতনতার জন্য ২০০৬ থেকে মে মাসের ১০ ও ১১ তারিখকে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও প্রাণি রক্ষা সম্পর্কিত সংগঠন গুলো এ দিবসটি গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকে। তবে সামাজিক সচেতনতা কতটুকু বৃদ্ধি করতে পেরেছে তা আমাদের কর্মকান্ড দেখলেই বুঝা যায়। যখন আমরা অতিথি হত্যা করে তাদের মাংস খেয়েই  আমাদের আতিথিয়তা পালন করে থাকি।

যে পাখি নিসর্গকে এত সুন্দর করে, চোখকে এত প্রশান্তি দেয়, সৌন্দর্য চেতনাকে এত আলোড়িত করে, নিরীহ সে পাখির প্রাণ নেওয়াতে কী এত সুখ মানুষের?

লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক